খান মাহমুদ আল রাফি
৪৭ কোটি টাকা গেল কোথায় ?
মেহেরপুরে ব্লাকবেঙ্গল ছাগলের জাত সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণের জন্য বড় বাজেটের দুটি সরকারী প্রকল্প সরকার হাতে নিলেও জেলা ও উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসের কর্মকর্তা কর্মচারীদের ব্যাপক দুর্নীতির কারণে প্রকল্পের পুরো অর্থ নয়ছয় হয়ে গেছে। ফলে-বিলুপ্তির পথে বিশ্বখ্যাত ব্লাকবেঙ্গল জাতের ছাগল। সম্প্রসারণ কাজ খাতাকলমে থাকলেও বাস্তবে এর ছিঁটেফোটাও নেই। খামারিদের অভিযোগ ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে এই ছাগল পালনে নিরুৎসাহিত হচ্ছে খামারিরা।
তাদের অভিযোগ-খামারি তালিকা তৈরিতে স্বেচ্ছাচারিতা ও চুক্তিবদ্ধ খামারীদের চুক্তিপত্রে খামারির স্থলে অফিসের কর্মচারীরা স্বাক্ষর করে ভ‚য়া তালিকা প্রস্তুত করা। যদিও এর দায় নিচ্ছেনা কোন কর্মকর্তা। তবে, কর্মকর্তাদের দাবী ব্লাকবেঙ্গল জাতের ছাগলের উন্নয়ন না হলেও সরকারের দেওয়া টাকায় অনেক গরিব মানুষ উপকৃত হয়েছে।
পৃথিবীতে প্রায় ৩০০ স্বীকৃত জাতের ছাগলের মধ্যে বাংলাদেশের স্থানীয় জাত ব্লাকবেঙ্গল ছাগল মাংসের স্বাদ ও চামড়ার গুনগত মানের জন্য বিশ্বসেরা ৫টি জাতের মধ্যে এটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। অধিক মাংস প্রাপ্তির আশায় যমুনাপারী ও অন্যান্য শংকর জাতের ছাগলের মাধ্যমে ব্লাকবেঙ্গল জাতের ছাগলের সংকরায়নের ফলে বাংলাদেশের মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা ও কুষ্টিয়া ছাড়া সারাদেশ থেকেই ব্লাকবেঙ্গল ছাগল প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছিলো।
অবশেষে এই জাত সংরক্ষণ ও সম্প্রাসরণের জন্য সরকার "ব্লাকবেঙ্গল ছাগলের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ প্রকল্প" এবং "ব্লাকবেঙ্গল ছাগলের জাত সংরক্ষণ ও উন্নয়ন গবেষনা প্রকল্প" নামে দুইটি প্রকল্প চালু করে। যার বাস্তবায়নের দয়িত্বে ছিলো প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর এবং বিএলআরআই এর।
কিন্তু প্রাণিসম্পদ অফিস মেহেরপুরের কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং বিএলআরআই এর প্রকল্প সংশি¬ষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্তদের পদে পদে দূর্ণীতি, খামখেয়ালীপণা ও স্বেচ্ছাচারিতার কারণে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলেও মেহেরপুরে ব্লাকবেঙ্গল ছাগলের জাত সম্প্রসারণের পরিবর্তে সেই জাত সম্পুর্ণ বিলুপ্তের পথে এখন।
ব্লাকবেঙ্গল ছাগলের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ প্রকল্পে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তত্বাবধায়নে মেহেরপুরে প্রতি উপজেলায় ১০জন সিজিএফ ও ২জন বøককিপার খামারি নিয়ে প্রকল্পের ১ম পর্যায়ের মেয়াদ শেষ হলেও বরাদ্দকৃত প্রণোদনা পায়নি খামারিরা। খাবার ঔষধ, ঘর ও দুধ বাবদ সিজিএফ খামারিদের ৫৮ হাজার ৮শত টাকা বরাদ্দ থাকলেও প্রকল্পের ৩ বছর শেষে শুধুমাত্র ঘর পেয়েছে মাত্র ৬জন খামারি।
খোঁজখবর নেওয়ার পর তড়িঘড়ি করে কোন রকমে বাকী ৪ জনের ঘরের কাজ শেষ করা হয়। বøককিপার খামারির জন্য ৩৮ হাজার ৮শত টাকা বরাদ্দ থাকলেও মেহেরপুর সদরে একজন পেয়েছে নগদ মাত্র ২০ হাজার টাকা। জেলায় বাকি ৫জন খামারিকে নামমাত্র কিছু খাবার দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি ব্লাকবেঙ্গল ছাগলের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ প্রকল্প থেকে বাজেট নিয়ে মেহেরপুরের হরিরামপুর গ্রামে লাল মিয়ার ছেলে মিজান (গ্রাম্য পশু চিকিৎসক) কে ছাগল রাখার জন্য ঘর তৈরি করে দিয়েছে মেহেরপুর সদর প্রাণিসম্পদ অফিস।
তথ্য নেয়ার জন্য ফোন দিলে ওই পশুচিকিৎসক মিজান স্বীকার করে বলেন- তার কোন ছাগল নাই। অথচ- সরেজমিনে সেখানে গিয়ে বøাকবেঙ্গল ছাগল খামারের সরকারি সাইনবোর্ড ও ঘর এবং বড় কান ওয়ালা ছয়টি যমুনাপারি ছাগল দেখা যায়। এ ব্যাপারে প্রকল্পের মাঠকর্মী সাইদুর রহমান লিজন বলেন, 'আমি মাঠকর্মী হিসেবে আছি, কোন সিদ্ধান্ত ক্রয় বা বিতরণের সাথে আমি জড়িত নই।
মেহেরপুরে ব্লাকবেঙ্গল ছাগল নেই এবং ব্লাকবেঙ্গল ছাগল প্রকল্পের তালিকা ক্রুটিযুক্ত কেন এ প্রশ্ন করলে প্রকল্পের মাঠকর্মী সাইদুর রহমান লিজন বলেন, 'আমার নিয়োগ হয়েছে প্রকল্প শুরুর দেড় বছর পর। এক্ষেত্রে খামারিদের যে লিস্ট সেটি করেছেন উপসহকারী প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মেহেরপুর সদর রহমত উল্লাহ বাবলু।
মুজিবনগরের বাককিপার খামারি সুকেন মন্ডল বলেন, 'আমাকে খাবারের বস্তার পাশে দাঁড় করিয়ে ছবি তুলে নিয়ে শুধুমাত্র একটি ছাগল ঘরের প্লাস্টিকের মাচা আর কিছু মেয়াদোত্তীর্ণ ঔষধ দিয়ে পরে সেই খাবারের বস্তা ফেরত নিয়ে চলে যায়। তারপর থেকে কোন যোগাযোগ নেই। তাই সরকার থেকে দেওয়া পাঠা ছাগল দুটি বিক্রি করে দিয়েছি।'
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক খামারি বলেন, ব্লাকবেঙ্গল ছাগল মেলায় যাদের এ জাতের ছাগল আছে তাদের বাদ দিয়ে অন্যদের পুরস্কার দেওয়া হয়। আবার পশু হাসপাতালে চিকিৎসা করতে গেলেও এ জাতের ছাগল পালন করতে নিরৎসাহিত করা হয় ।
প্রকল্পের সাড়ে তিন বছরের অধিক সময় শেষ হওয়ার পর মেহেরপুরে ব্লাকবেঙ্গল ছাগল বৃদ্ধির পরিবর্তে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে কেনো এই প্রশ্নের উত্তরে মেহেরপুর জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা সাইদুর রহমান বলেন, 'মেহেরপুরে এই জাতের ছাগল খুঁজে পাওয়া মুশকিল। এই অঞ্চলের খামারিরা মূলত গরু মোটাতাজাকরণের মতো ছাগল মোটাতাজা এবং মাংস উৎপাদনে বেশি আগ্রহী।
তাছাড়া খামারদের তালিকা প্রস্তুতের সময় আমি এখানে কর্মরত ছিলাম না। চুক্তিবদ্ধ খামারীদের চুক্তিপত্রে খামারির স্থলে অফিসের কর্মচারীরা স্বাক্ষর করেছেন এবং খামারিদেরকে কোন কপি দেননি এটা আমার জানা ছিলো না। তবে গাংনীতে ব্লাকবেঙ্গল ছাগল মেলা না করে পছন্দের খামারিকে অফিসে ডেকে এনে পুরস্কার তুলে দেয়া হয়েছে এই তথ্য সঠিক নয়।' কথা বলার এক পর্যায়ে ডিএলও সাইদুর রহমান আবেগতাড়িত কণ্ঠে বলেন, 'আমি মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। এদেশের স্বাধীনতাই আমার বাবার অবদান আছে। আসলে ভালো মানুষের শত্রু বেশি হয়। তাই আমি চেষ্টা করছি এখান থেকে অন্য কোন জেলাতে চলে যাওয়ার।
' ব্লাকবেঙ্গল ছাগলের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ প্রকল্পের পিডি শরিফুল হকের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, 'প্রকল্পটি ১ম ফেজ শেষ করে ২য় ফেজে ৫ বছরের জন্য এক্সটেনশন হচ্ছে। তাই প্রকল্প নিয়ে নেগেটিভ রিপোর্ট না করে পজিটিভ রিপোর্ট করেন।' মাঠে ব্লাকবেঙ্গল ছাগল বিলুপ্ত তাহলে পজিটিভ রিপোর্ট কিভাবে করব! এ প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ব্লাকবেঙ্গল ছাগলের বৈশিষ্ট্যগুলো তুলে ধরেন, উপকারিতা তুলে ধরেন, যাতে মানুষ বেশি বেশি ব্লাকবেঙ্গল ছাগল পালন করে।
সদ্য সমাপ্ত প্রথম পর্যায়ে প্রকল্পের বাজেট কত ছিল জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, '১৯৪টি উপজেলার জন্য ৪৭ কোটি টাকা।' তাহলে প্রথম পর্যায়ে সরকারি এই ৪৭ কোটি টাকার কি ফলাফল পাওয়া গেল এই প্রশ্ন করলে তিনি বলেন- অনেক দরিদ্র মানুষ উপকৃত হয়েছে। ছাগল পালনের ঘর বানিয়ে দেয় হয়েছে। কিন্তু প্রকল্পের যে উদ্দেশ্য ব্লাকবেঙ্গলছাগল পালনকে সম্প্রসারিত করা এটার অগ্রগতি কতটুকু হলো এ প্রশ্নটিই তিনি এড়িয়ে যান।