আশপাশের জেলাকে পিছনে ফেলে ঈর্ষাণ্বিত গতিতে এগিয়ে চলছে মেহেরপুর। অবশেষে মেহেরপুরে মুজিবনগর নামে পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে। এ সংক্রান্ত বিল মহান সংসদে উত্থাপিতও হয়েছে। এতেই আলোর ঝিলিক পড়েছে শিক্ষার্থী অভিভাবকদের চোখেমুখে। উচ্চশিক্ষার ভবিষ্যৎ নিয়ে উচ্চকিত, আনন্দিত, নিশ্চিত, পুলকিত এখন সবাই। কারণ আর ক’দিন অপেক্ষা করলেই মেহেরপুরে শিক্ষার্থীদের কাউকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য কষ্ট সহ্য করে দূর কোথাও যেতে হবে না। বরং দূরের শিক্ষার্থীরা মেহেরপুরে আসবে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য। নি:সন্দেহে এটা বাস্তবায়ন হলে মেহেরপুরের প্রাপ্তির ঝুঁড়ি ভারী হবে অনেক। বদলে যাবে এলাকার আর্থসামাজিক অবস্থা। এটাতেই শেষ নয়-এমন আরও কত সুখবর এখন মেহেরপুরের উন্নয়নের অপেক্ষমান তালিকাকে দীর্ঘ করে আছে।
সবমিলিয়ে একগুচ্ছ উন্নয়ন প্রকল্প এবং পরিকল্পনা নিয়ে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে মেহেরপুর। ঐতিহাসিক মুজিবনগরখ্যাত মেহেরপুর এতদিন পিছিয়ে পড়া জনপদ ছিল। স্বাধীনতা পরবর্তী কোন সরকারেরই সুদৃষ্টিতে ছিল না কৃষি নির্ভর এই সীমান্ত জেলা। তবে, এবার খোদ প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টি পড়েছে মুক্তিযুদ্ধের তীর্থস্থান ঐতিহাসিক মেহেরপুর মুজিবনগরের উপর। সেই সাথে মেহেরপুর-১ আসনের এমপি জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক ফরহাদ হোসেন এর ঐকান্তিক চেষ্টায় পঞ্জিভূত স্বপ্নগুলো আজ হাতের মুঠোয় এসেছে। সবমিলিয়ে উন্নয়নের সুবাতাস বইছে মেহেরপুর জেলাজুড়ে।
এই জেলায় সরকার গুরুত্বপূর্ণ কিছু উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিয়েছেন যেগুলো বাস্তবায়ন হলে জেলায় কর্মসংস্থানের ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টির পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবে কয়েকধাপ এগিয়ে যাবে এই জেলা। সূচিত হবে অর্থনীতির নতুন দিগন্ত। উন্মেচিত হবে সুযোগ সুবিধার সব পথ। তিনটি লক্ষণীয় বিষয় মেহেরপুরের উন্নয়নের সমীকরণ হয়ে কাজ করছে বলে দাবী উন্নয়ন ভাবুক চিন্তাশীলদের। যেমন এক-বঙ্গবন্ধুর নামে দেশের একমাত্র স্থান মুজিবনগর মেহেরপুর, দুই- প্রধানমন্ত্রী যে মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, সেই মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মেহেরপুরের সুসন্তান এমপি ফরহাদ হোসেন,তিন-গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু থেকে মেহেরপুরের মুজিবনগর সৃষ্টি। তাই সরকার গোপালগঞ্জ এবং মুজিবনগরকে একই সুতোয় বুনতে চায়। যদিও বিগত আমলে মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ এলাকা ঘিরে কিছু উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ অতীতে শেষ হলেও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতগত কারণে তার কোন কিছুই কাজে আসেনি।
সেই আক্ষেপ থেকে বর্তমান সরকার ঐতিহাসিক মুজিবনগরকে আর্ন্তজাতিকমানের করতে সেখানে সহস্র কোটি টাকার পরিকল্পিত উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিয়েছেন। এটা বাস্তবায়ন হলে শুধু দেশে বা এশিয়ায় নই, নিজ দেশের স্বাধীনতার স্মৃতিকে জীবন্ত করে ধরে রাখতে বাংলাদেশে এটাই হবে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সর্ববৃহৎ প্রকল্প। যে প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে বদলে যাবে মুজিবনগরের চিত্র। ভীড় হবে দেশি বিদেশী পর্যটক দর্শনার্থীদের। কর্মসংস্থান ও ব্যবসা বাণিজ্যের নানামুখি সুযোগ সৃষ্টি হবে। বৃদ্ধি পাবে রাজস্ব আয় ও মানুষের অর্থনৈতিক মানদন্ড। মেহেরপুরে পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়টি এতদঞ্চলে উচ্চশিক্ষার সবচেয়ে বড় পীঠস্থান হবে।
দেশি বিদেশী হাজার হাজার শিক্ষার্থী এখানে আসবে, ভর্তি হবে, পড়াশুনা করবে, তাদের আবাসন সুবিধা থাকবে। সীমান্ত ঘেঁষা হওয়ায় এই বিশ্ববিদ্যালয় ভারতের শিক্ষার্থীদের কাছে সবচেয়ে সহজ এবং আর্কষণীয় হবে। ৩০ থেকে ৩৫ হাজার শিক্ষার্থীর সমাবেশ ঘটবে এই বিশ্ববিদ্যালয় আঙ্গিনায়। ফলে, মেহেরপুরের বাজার অর্থনীতিতে এর বিরাট প্রভাব পড়বে। দেশ বিদেশের শিক্ষিত জনগোষ্টির কাছে মেহেরপুর পুর্ণ:বার পরিচিত নাম হয়ে উঠবে। মুজিবনগর যেতে বন্দর সড়ক পার্শ্বে নির্মিত হচ্ছে ছহিউদ্দিন টেক্সটাইল ইন্সটিটিউট। চালু হয়েছে মুজিবনগর টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজ এবং পুলিশ লাইনস এর পার্শ্বে অবস্থিত সরকারী কারিগরি প্রশিক্ষিণ কেন্দ্র। এগুলো মধ্যদিয়ে শুধু উচ্চশিক্ষাই নয়, প্রযুক্তিগত শিক্ষাতেও এগিয়ে যাবে এই জেলার শিক্ষার্থীরা। দক্ষ জনবলে পরিণত হবে এই জেলার তরুণ তরুণীরা। যে জনবল বিদেশে কর্মসংস্থানের মাধ্যমে আরও বেশি রেমিট্যান্স তখন পাঠাতে সক্ষম হবে।
ঐতিহাসিক মুজিবনগরের ঐতিহাসিক গুরুত্বকে বিবেচনায় নিয়ে সরকার চুয়াডাঙ্গা-দর্শনা হয়ে মুজিবনগর-মেহেরপুর-কুষ্টিয়া রেলপথ নির্মানের কাজ শুরু হয়েছে। এই রেলপথ নির্মান হলে জেলার সাথে সারাদেশের যাতাযাতের সর্বদুয়ার খুলে যাবে। সহজেই পণ্য আনা নেওয়া সম্ভব হবে। ব্যবসা বাণিজ্যের সম্ভাবনা ও পরিমন্ডলের বিস্তৃতি ঘটবে। স্বাধীনতায় ভারতের বন্ধুত্বের অবদানস্বরূপ সীমান্তে তৈরী করা হয়েছে স্বাধীনতা সড়ক। এই সড়ক দিয়েই ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল ভারতে থেকে দেশের জাতীয় নেতারা ও ভারতীয় অতিথিরা মুজিবনগর এসেছিলেন।
দেশের স্বাধীনতায় বন্ধু রাষ্ট্র ভারতের অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ দুই দেশ মুজিবনগরে চেকপোষ্ট ও স্থলবন্দর নির্মানের এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এজন্য ৩০ একর জমিও অধিগ্রহণ করা হবে। এই স্থলবন্দর এবং রেলপথ ভারত-বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ও পর্যটন সম্পর্ককে এগিয়ে নিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখবে বলছেন ব্যবসায়ীরা। ঐতিহাসিক মুজিবনগরের কারণে মুজিবনগর থেকে মেহেরপুর-কুষ্টিয়া সড়ক প্রায় সাড়ে ৪শ কোটি টাকা ব্যায়ে চার লেনে প্রশস্ত করা হচ্ছে। যোগাযোগ ক্ষেত্রে এই আমুল পরিবর্তন মেহেরপুরকে উন্নয়নের মহাসড়কে প্রবেশ করাবে। তখন মেহেরপুরের সাথে উত্তরাঞ্চলের দূরত্ব একেবারেই কমে আসবে।
জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন, এমপির আন্তরিকতা এবং জোরালো পদক্ষেপে উল্লেখিত মৌলিক এবং মেগা প্রকল্পের বাইরেও মেহেরপুরের কৃষি ও মৎস্য সম্পদ উন্নয়নে জেলার তিন দিক পরিবেষ্টিত ভৈরব নদী শত কোটি টাকা ব্যায়ে পুণ:খনন করা হয়েছে। এতে নদী দুইপারের ২১ হাজার হেক্টর জমি আবার নতুন করে সেচ সুবিধা পাচ্ছে। এখন খরা মৌসুমে পানি সঙ্কটে পড়ে ফসলহানির মুখে পড়তে হয় না। খননের কারণে ভৈরবের পানিপ্রবাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় নদীবুকে বছরে শত কোটি টাকার মাছ উৎপাদন হচ্ছে।
এখন কালের বিলুপ্ত নৌকাবাইচ আবার শুরু হয়েছে ভৈরব নদীবক্ষে। ভৈরবের দুইপাড় মাটি ভরাট করে যাতাযাতের পথ নির্মাণ করা হয়েছে। নদী তীরে তৈরী হয়েছে অসংখ্য কফি হাউজ এবং বসার সুন্দর সুন্দর স্থান। ফলে, এক সময়ের রুগ্ন রুক্ষ মরা ভৈরব যেমন স্রোতস্বীণি হয়েছে, তেমনি বিনোদনেরও কেন্দ্রবিন্দু হয়েছে। বিকেল হলে একটু নির্মল বিশুদ্ধ হাওয়া নিতে এবং মনকে সতেজ করতে ভ্রমন রসিক সবাই ছুটে যায় ভৈরব নদী তীরে। শুধু তাই নয়- জেলার সর্বত্র মসৃণ পাকা পিচ সড়ক হয়েছে। ফলে, সহজেই সীমান্ত গ্রাম সহ জেলার যে কোন প্রান্তে যে কোন সময় ঘুরে বেড়ানো যায় নিশ্চিন্তে নিরাপদে।
এ সময় গ্রামগঞ্জ সর্বত্র ঘুরলে বিস্তৃর্ণ সবুজমাঠ আর গাছগাছালী ভেদ করে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা বহুতল বিশিষ্ট একই ডিজাইনের নতুন রঙিন বিদ্যালয়ভবনগুলো দেখলে চোখ ও মন ভরে যায়। কারণ দীর্ঘদিন অবহেলায় সঙ্কটে থাকা এই মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলো এখন শিক্ষার মান উন্নয়নে সক্রিয় হয়েছে। বেহাল স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে আধুনিক করতে ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালে নতুন ৮তলা ভবন নির্মাণকাজ এখন শেষের দিকে। এখানে চিকিৎসক সহ জনবল বৃদ্ধি পেয়েছে। ওষুধ সঙ্কট নেই। আধুনিক এ্যম্বুলেন্স হয়েছে। যন্ত্রপাতি, সুযোগসুবিধা বেড়েছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দ্বারা উন্নত চিকিৎসা হচ্ছে। পাশেই তৈরী হচ্ছে নার্স ট্রেনিং ইন্সটিটিউড। গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণে এতদিন পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকা ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলো পুরোদমে চালু হয়েছে। এখন গ্রামীণ জনগোষ্টি পা বাড়ালেই ঘরে বসে চিকিৎসা সুবিধা পাচ্ছে। বিদ্যুৎ সুবিধা সর্বত্র পৌঁছে দিতে সর্বত্র বিদ্যুৎ সংযোগ লাইন স্থাপনের পাশাপাশি নিরবিছিন্ন বিদ্যুৎ সুবিধা নিশ্চিত হয়েছে।
বিদ্যুতের চাহিদা এবং প্রাপ্তিকে নিশ্চিত করতে মেহেরপুর চুয়াডাঙ্গা সড়কের বারাদীতে ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। এই অঞ্চলের কৃষিকে টেকসই ও প্রযুক্তিনির্ভর করতে কৃষি গবেষণা কেন্দ্র নির্মাণ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। যেখানে ৪০ অধিক গবেষক কৃষি উদ্ভাবন নিয়ে গবেষণা করবে। মেহেরপুরে মেরিন একাডেমী করার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। ঝিমিয়ে পড়া ক্রীড়াঙ্গনকে চাঙ্গা করতে শেখ রাসেল আধুনিক মিনি ষ্টেডিয়াম হচ্ছে। জগতটাকে তরুণদের হাতের মুঠোয় নিতে তৈরী হচ্ছে শেখ কামাল আইটি পল্লী। মৌলিক এই সমস্ত উন্নয়নের বাইরেও সরকারী সেবা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে অনেক সরকারী অফিসভবন নির্মানকাজ চলছে মেহেরপুরে।
যেমন-পাসপোর্ট অফিস, পানি উন্নয়ন অফিস সহ অনেক অফিস আধুনিকায়ন করা হয়েছে। ভাবুন তো এগুলো সব বাস্তবায়ন হলে আপনার প্রিয় মেহেরপুর কোন উচ্চতায় পৌঁছুবে ? ভাবুন তো তখন আপনার নাগরিক এবং পেশাগত দায়িত্ব ও সুবিধা বেড়ে যাবে কতগুন ? কারণ তখন হাত বাড়ালেই স্বপ্ন ধরা দিবে আপনার হাতের মুঠোয়।