স্বাধীন জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর পার হয়েছে বাঙালির ৫১ বছর। বিশ্ব মানচিত্রে ঠাঁই করে নেওয়ার পর মহান স্বাধীনতার ৫২তম বার্ষিকী উদযাপন করছে বাংলাদেশ। কিন্তু এখনো মহান স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী রাজাকারদের তালিকা আলোর মুখ দেখেনি। ২০১৯ সালে করা তালিকাটি বিতর্কের মুখে স্থগিত করে সরকার। জাতীয় সংসদে আইন পাসের পর নতুন তালিকার প্রকাশের বিষয়ে কাজ শুরু হবে।
এর আগে ২০১৯ সালে বিজয় দিবসের আগের দিন রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস, শান্তি কমিটি ও স্বাধীনতাবিরোধী ১০ হাজার ৭৮৯ জনের তালিকা প্রকাশ করেছিল মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়। সেই তালিকাটি নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক হওয়ায় পরে সেটি স্থগিত করে সরকার।
ওই তালিকায় গেজেটভুক্ত অনেক মুক্তিযোদ্ধার নাম এসেছে। খোদ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে নিয়োজিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান কৌঁসুলির নাম, বরিশালের বাসদ নেত্রী মনীষা চক্রবর্তীর বাবা গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা তপন চক্রবর্তীসহ বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর ও মুক্তিযোদ্ধার নাম তালিকায় এসেছিল। এটি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খুবই অসম্মানের বিষয় বলে মন্তব্য আসে খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার।
২০১৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর প্রকাশিত সেই তালিকা ২০২০ সালের ২৬ মার্চ পর্যন্ত স্থগিত করা হলেও এখন পর্যন্ত সেটির সংশোধিত তালিকা প্রকাশ করা হয়নি। এতে নানা মহলে উঠেছে সমালোচনা।
রাজাকারের তালিকা হচ্ছে এমন ঘোষণা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর পক্ষ থেকে একাধিকবার দেওয়া হয়েছে। এমনকি তালিকা প্রকাশের সময়সীমাও দেওয়া হয়েছিল। সেসব ঘোষণা আর প্রতিশ্রুতি এত দিনেও বাস্তবে রূপ পায়নি। কথা ছিল খুব শিগগির তালিকা নতুনভাবে প্রকাশ করা হবে। কিন্তু তা হচ্ছে না বলেই জানা গেছে। এ বিষয়ে ঢাকা টাইমস যোগাযোগ করে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে। কিন্তু তাদের বক্তব্য দায় এড়ানোর মতো।
রাজাকারের তালিকা এখনো প্রকাশ না হওয়ায় ক্ষোভ ঝেড়ে একজন মুক্তিযোদ্ধা ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আমরা দেশকে স্বাধীন করার জন্য মুক্তিযুদ্ধের সময় সম্মুখযুদ্ধ করেছি। কিন্তু তখন স্বাধীনতার বিরোধীরা চেষ্টা করেছে আমরা যেন স্বাধীন হতে না পারি। তাদের তালিকাটি খুব তাড়াতাড়ি প্রকাশ হওয়া দরকার। আমার অনেক সহযোদ্ধা ইতোমধ্যে মারা গেছেন। আমরা যারা বেঁচে আছি আমাদেরও বয়স অনেক হয়ে গেছে। কিন্তু মরার আগে এদের তালিকাটা দেখে যেতে পারলে শান্তি পেতাম।’
রাজাকারের তালিকা কত দূর এগিয়েছে এ বিষয়ে কথা হয় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (গেজেট, সনদ ও প্রত্যয়ন অনুবিভাগ, অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো. মোফাজ্জল হোসেনের সঙ্গে। তিনি ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘পুরনো ওই তালিকা বাতিল হওয়ার পর নতুন তালিকা এখনো প্রকাশ করা হয়নি। কারণ এটি এখনো আইন আকারে মহান সংসদে পাস হয়নি। আইন পাস হলেই খুব তাড়াতাড়ি কাজ শুরু করা হবে।’
আগের তালিকায় ভুল করে আসা মুক্তিযোদ্ধাদের নাম বাদ দিয়ে রাজাকারদের নাম দেওয়ার বিষয়ে এক প্রশ্নে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এই যুগ্ম সচিব বলেন, ‘এটি খুবই স্পর্শকাতর বিষয়। এখন এ বিষয়ে কিছু বলতে পারছি না। যা হবে আইনের ভিত্তিতেই হবে।’
রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীসহ স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকা তৈরি করার বিধান রেখে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইনের সংশোধিত খসড়া ইতিমধ্যে মন্ত্রিসভার সায় পেয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে গত ১৭ জানুয়ারি মন্ত্রিসভার বৈঠকে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইন ২০২২-এর খসড়া চূড়ান্ত অনুমোদন পায়।
বর্তমান আইনে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারীদের তালিকা প্রকাশের বিষয়ে কিছু উল্লেখ নেই। তাই এই তালিকার বৈধতা দিতে ২০০২ সালের জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইন সংশোধন করা হচ্ছে। সংশোধিত আইনে কাউন্সিলের সদস্য সংখ্যা ১১ জন করা হয়েছে। আগের আইনে ৯ জন ছিল। এদিকে গত ৪ মার্চ গাজীপুরের একটি অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী মোজাম্মেল হক জানান, রাজাকারের তালিকা তৈরির আইন সংসদে ইতিমধ্যে জমা দেয়া হয়েছে। পরবর্তী অধিবেশনে পাস হলেই তালিকা তৈরির কাজ শুরু হবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় যেহেতু স্বাধীনতাবিরোধী একেক বাহিনীর একেক রকম ভূমিকা ছিল, সেহেতু নিপীড়ক বাহিনীগুলোর আলাদা আলাদা তালিকা হওয়া উচিত। অপরাধের ধরনভেদে মুক্তিযুদ্ধে কোন বাহিনীর কী ভূমিকা ছিল সেটি স্পষ্ট করে স্বয়ংসম্পূর্ণ তালিকা প্রস্তুত করতে সরকার পর্যায়ক্রমে সেদিকেই অগ্রসর হবে তাদের আশাবাদ।