হকার ব্যবসায়ীদের দখলে মেহেরপুর, গাংনীর সমস্ত ফুটপাত
টপ নিউজ মেহেরপুর

হকার ব্যবসায়ীদের দখলে মেহেরপুর, গাংনীর সমস্ত ফুটপাত

সবার সংবাদ ডেস্ক:

শিক্ষার্থী, পথচারীদের ঝুঁকি নিয়ে সড়কে চলাচল, বাড়ছে দুর্ঘটনা

মেহেরপুর পৌর শহর এলাকা এবং গাংনী শহরের সমস্ত ফুটপাত এখন ব্যবসায়ী হকারদের দখলে চলে গেছে। পৌর কর্তৃপক্ষের নেই কোন নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। অথচ-কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে নাগরিক সুবিধা বৃদ্ধিতে পথচারীদের নিরাপদ সড়ক চলাচলের জন্য নির্মিত হয়েছে এই সমস্ত ফুটপাত। কিন্তু সেই ফুটপাত দখলে চলে যাওয়ায় পথচারী শিক্ষার্থীরা ঝুঁকি নিয়ে সড়কে যানবহনের সাথে তাল মিলিয়ে চলাচল করতে বাধ্য আজ। একে সড়ক ব্যবস্থা যেমন ভেঙ্গে পড়েছে, তেমনি দুর্ঘটনা ঝুঁকি দিনদিন বেড়েই চলেছে। অভিযোগ রয়েছে-পৌরসভার কতিপয় কাউন্সিলর এবং প্রভাবশালীরা অর্থের বিনিময়ে এই সমস্ত হকার ও ব্যবসায়ীদের ফুটপাত দখল করে ব্যবসা পরিচালনার সুযোগ করে দিয়েছে।

মেহেরপুর শহরের ড. শহীদ শামসুজ্জোহা পার্কের সামনের ফুটপথের ব্যবসায়ী তুহিন আহমেদ বলেন-অনেকে অনেককে পয়সা দিয়ে ফুটপাতে ব্যবসা করছে শুনেছি। আমি এখানে কাউকে কোন টাকা পয়সা দিই না। তবে এর আগে একবার বড়বাজার ব্যবসায়ী সমিতি থেকে আমাদের কাছ থেকে টাকা নেওয়া হয়েছিল। পরে মেয়র নিষেধ করে দিলে আর কাউকে আমার টাকা দেওয়া লাগেনি। ফুটপাতে ব্যবসা করার কারণে পথচারীদের সমস্যার কথা জিজ্ঞেস করলে বলেন-আমাদের কারণে পথচারীদের সমস্যা তো হয়ই। আমাদের বসার সুযোগ করে দিয়েছে। কেউ কিছু বলেনা।

পৌর কমিউনিটি সেন্টারের সামনে ফুটপাত ব্যবসায়ী রাব্বি হোসেন বলেন-মন্ত্রী মহোদয়ের বাড়ির সামনে আমরা ফুটপাত দখলে নিয়ে ব্যবসা করি। এতে রাস্তায় জটলা হয়। শিক্ষার্থীরা ফুটপাত ব্যবহার করতে পারেনা সত্যি। তবে এজন্য আমরা দায়ী না। কর্তৃপক্ষ নিষেধ করলে আমরাও পথচারীদের বাধা হয়ে ব্যবসা করবো না। বর্তমান অবস্থায় ফুটপাত দিয়ে পথচারী ও শিক্ষার্থীদের নিরাপদে পথ চলাচলের কোন সুযোগ নেই। কারণ শহরের সমস্ত ফুটপাত সম্পূর্ণরূপে ব্যবসায়ী হকারদের দখলে চলে গেছে। তাই রাস্তায় রিক্সা, অটো, মোটরসাইকেল, বাস, ট্রাক, নসিমন, করিমন যানবহনের মত দ্রæতগতির যানবহনকে পাশ কাটিয়ে নিজেকে রক্ষা করে চলাচল খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

একজন পথচারী বলেন-চোখের সামনে অনেককে দুর্ঘটনার শিকার হতে হচ্ছে। এ কারণে ফুটপাত হারিয়ে সড়ক চলাচল এখন অনিরাপদ সত্বেও মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে চলাচল করতে বাধ্য হচ্ছে সকলে।

শিক্ষার্থী সুমাইয়া সুলতানা জানান- মেহেরপুর গার্লস স্কুলে ক্লাস নাইনে পড়ি। শহরে ফুটপাত আছে কিন্তু কোনদিন সেই ফুটপাত দিয়ে চলাচলের সুযোগ পাইনি। কারণ ফুটপাত হকারদের দখলে। এজন্য স্কুল এবং বাড়ি না পৌঁছানো পর্যন্ত নিজে এবং পরিবার জীবন নিয়ে আশঙ্কায় ভুগি। কারণ ব্যস্ত সড়কে সর ধরণের যানবহনের সাথে ঝুঁকি নিয়ে প্রতিদিন চলতে হয়। মেহেরপুর প্রথম শ্রেণীর পৌরসভা। নাগরিক সুবিধা বৃদ্ধিতে এই পৌরসভায় তৃতীয় শহর উন্নয়ন প্রকল্প চালু আছে। অথচ- এতদিনেও এই শহরে নিরাপদ সড়ক গড়ে ওঠেনি।

একই অবস্থা মেহেরপুরের গাংনী উপজেলা শহরেও। সেখানেও শহরের সমস্ত ফুটপাত হকারদের দখলে চলে যাওয়ায় মানুষজনকে পরিবহনের সাথে পাল্লা দিয়ে চলাচল করতে হচ্ছে। সবমিলিয়ে মেহেরপুরে এবং গাংনীতে সড়ক শৃঙ্খলা একেবারেই নেই বললেই চলে।

পরিবহনের ফাঁকফোকড় দিয়ে গাংনী ত্রিমোহনি মোড় অতিক্রম করে ভীতসন্ত্রস্থ চেহারায় হালিমা খাতুন একহাতে নাতিতে অন্য হাতে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে যাচ্ছিলেন র‌্যাব ক্যাম্পের দিকে। তাকে প্রশ্ন করা হলে বললেন-ওরে বাবা পথচলার জো নেই। শুধু গাড়ি আর মানুষ। শহরে গাড়ি চলার রাস্তা আছে কিন্তু মানুষ চলার রাস্তা নেই। তাই শহরে এলি জীবনডা কখন যায় যায় এই ভয়ি থাকি। দেখা গেছে- প্রায়শ: ট্রাফিক পুলিশকে মোটরসাইকেল থামিয়ে কাগজ যাঁচাই অথবা মামলা দিতে। কিন্তু অন্যান্য অবৈধ পরিবহন নিয়ন্ত্রণে কার্যকর কোন ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি।

অভিযোগ রযেছে-মেহেরপুর জেলায় ফিটনেস বিহীন বাস ও ট্রাকের পাশাপাশি অবৈধ যানবহনের চলাচল ক্রমশ: বৃদ্ধি পেয়ে এখন আশঙ্কাজনক পর্যায়ে চলে গেছে। এই সমস্ত অবৈধ পরিবহন নিয়ন্ত্রণে বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ এবং ট্রাফিক বিভাগের উদাসিনতা ও কতিপয় অসাধু কর্মকতার অবহেলা দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। সরেজমিনে দেখা গেছে- মেহেরপুর শহরের কোর্ট এলাকা থেকে শামসুজ্জোহা পার্ক হয়ে বড়বাজার সহ তার দুই পাশের প্রধান সড়কের সমস্ত ফুটপাত হকার ব্যবসায়ীদের দখলে চলে গেছে।

বিশেষ করে শহরের ফুলের দোকানগুলো, গার্লস স্কুল ও পৌরসভার সামনে, কোহিনূর মোড়, চুলকানির মোড়, পুরানো বাসষ্ট্যান্ড এলাকা, বড়বাজার থেকে কালীমন্দির পর্যন্ত এলাকা সমূহে ফুটপাত থাকলেও সব হকারদের দখলে। গাংনী শহরের হাসপাতাল থেকে ত্রিমোনি মোড় পর্যন্ত সড়ক ও জনপথ বিভাগের বিশাল ফুটপাত এলাকার কোথাও মাইক্রোষ্ট্যান্ড কোথাও দোকান গড়ে উঠেছে। ফলে হাইওয়ে সড়ক দিয়েই পথচারীদের চলতে হয়।

গাংনী ত্রিমোহনি মোড় থেকে র‌্যাব ক্যাম্প এবং থানা রোড়ের দিক যেতে পৌসভার সমস্ত ফুটপাত ব্যবসায়ীদের মালামালে কিংবা হকারদের পণ্যে ভরে থাকে। এই সমস্ত ফুটপাত ব্যবহারের নুন্যতম সুযোগ হয়না পথচারী ও শিক্ষার্থীদের। অথচ-এই সমস্ত অসঙ্গতি ও জনদুর্ভোগ লাঘবে কেউ দেখার নেই। নেই প্রতিকারের কোন কার্যকর উদ্যোগ। দিন রাত মানুষের পদচারণায় মুখর থাকার কথা যে স্থান গুলো, সেই ফুটপাতে এখন হেঁটে চলাচল উপায় নেই।

পুরো ফুটপাত জুড়েই গিজগিজ করছে দোকান। ফুটপাতগুলো হকাররা দখল করে ব্যবসা করলেও এর নেপথ্যে আছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। হকাররাও এসব সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি। প্রতিদিনই চলছে নির্দিষ্ট অঙ্কের উশুলি। কোন এক অদৃশ্য শক্তির কারণে তাদের এই আধিপত্যতা। যে কারণে মাঝে মধ্যে উচ্ছেদ করার পরও দখলমুক্ত করা যাচ্ছে না ফুটপাতগুলো। ফুটপাত দখল করা হকারদের কোনোভাবেই ঠেকাতে পারছে না মেহেরপুরের দুটি পৌরসভা ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ফলে রাজস্ব হারানোর পাশাপাশি পৌর ফুটপাতগুলির ভৌত কাঠামোও ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।

কথা হয় পথচারী রাফিয়া খাতুনের সঙ্গে। তিনি বলেন, পুরো মেহেরপুরেই ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যাওয়ার কোনো পরিস্থিতি নেই। সবগুলো ফুটপাতে অতিরিক্ত দোকান, নির্মাণ সামগ্রী তার মধ্যে মানুষের হেঁটে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। যেখানে ফুটপাত দিয়ে পুরুষ মানুষই হাঁটতে পারে না আমরা মেয়ে মানুষ কীভাবে হাঁটবো।

পৌর এলাকার ফুটপাতের এক কাপড় ব্যবসায়ী বলেন, টাকা দিয়ে দোকান বসাইছি, আবার প্রতিদিন চাঁদাও দিতে হয়। বাজারে দোকানঘর নেয়ার মতো তো পুঁজি নাই। তাই প্রতিদিন লাইনম্যানকে টাকা দিয়ে দোকান চালাই। গাংনী বাসস্ট্যান্ডের ফল ব্যবসায়ী হেলাল (৪৫) বলেন-নগদ টাকা লাইনম্যানকে দিয়ে ব্যবসা করে ১৮ বছর এখানে টিকে আছি। তিনি বলেন, ফুটপাত আসলে মানুষের হাঁটার জন্য কিন্তু আমরা অন্য কোন উপায় না পেয়ে এখানে দোকান বসিয়ে ব্যবসা করে খাচ্ছি।

গাংনী র‌্যাব ক্যাম্পের সামনে ফুটপাতের জুতা ব্যবসায়ী আবু আহমেদ শেখ (৬৯) বলেন,'গাংনী হাটের ইজারাদার আব্দুস সামাদের লাইনম্যান বাবুকে দৈনিক ৫০ টাকা উশুলি দিয়ে আমি এখানে ব্যবসা করি। আমাকে দোষ দিয়ে লাভ নাই। কারণ এখানে অনেক শক্তিশালী সিন্ডিকেট আছে যারা প্রতিদিন চাঁদা নেয়।

বিভিন্ন হকার সূত্রে জানা গেছে, মেহেরপুর সদরে শতাধিক ও গাংনীতে প্রায় তিন শতাধিক হকার থেকে ব্যবসার ধরন ভেদে দোকান প্রতি প্রতিদিন ৫০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত দিতে হয় তাদের। কিন্তু এসব টাকা মূলত কাদের হাতে যাচ্ছে এর উত্তর দিতে নারাজ তারা।

মেহেরপুর পৌর এলাকার ফুটপাত হকার মুক্ত করার উদ্দ্যোগের ব্যাপারে জানতে গেলে মেহেরপুর পৌরসভার সচিব জি এম উবায়দুল্লাহ মেয়রের অনুপস্থিতিতে কিছু বলতে রাজি হননি। এ ব্যাপরে কথা বলার জন্য ট্রাফিক ইন্সপেক্টর ফেরদৌস হাসানকে মুঠোফোনে কয়েকবার কল দিলেও তিনি কল ধরেননি।

গাংনী পৌর মেয়র অহমদ আলীর সাথে এ ব্যাপারে মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, এই মুহুর্তে আমি বাইরে আছি। ফ্রি হয়ে আপনাকে কল দেবো।

গাংনী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোছাঃ রনী খাতুন বলেন-আমি অতি সম্প্রতি এখানে দায়িত্ব নিয়েছি, একটু খোঁজ নিয়ে দেখি, তারপর অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবো।