বিনোদন ডেস্ক :
আকাশের হাতে আছে, একরাশ নীল বহু জনপ্রিয় গানের স্রষ্টা চিত্রনাট্যকার এবং চলচ্চিত্র পরিচালক গাজী মাজহারুল আনোয়ার চলে গেলেন জীবনের ওপারে।
১৯৬০ এর দশকের মাঝামাঝি। মিউজিক ডিরেক্টর সত্য সাহা এক তরুণকে নিয়ে গেলেন সুভাষ দত্তের কাছে। ছেলেটা গান লেখে। তার লেখা গান সিনেমায় ব্যবহার করতে চান সত্য সাহা। কিন্তু তিনি যে উৎসাহ নিয়ে গেলেন, সেটাতে শুরুতেই পানি ঢেলে দিলেন সুভাষ দত্ত।
ছেলেটাকে দেখে তিনি অবজ্ঞা করেই বললেন, “এ কাকে নিয়ে এসেছো সত্য? ও কি আমার স্ট্যাটাসের গান লিখতে পারবে?” এত বড় দুজন মানুষের সামনে ছেলেটা ঠিক কী বলবে বুঝতে পারছিলো না।
সুভাষ দত্তের কথা শুনে সত্য সাহা কিছুটা মনক্ষুণ্ণ হলেন। তিনি বললেন, “দাদা, কাউকে পরীক্ষা না করে তো আপনি এভাবে বলতে পারেন না। ছেলেটা খুব ভালো লিখছে ইদানিং।” সত্য সাহার কথা শুনে নিতান্ত অনিচ্ছায় তিনি ছেলেটাকে তার পরবর্তী ছবির একটা দৃশ্য বুঝিয়ে দিয়ে তখনই একটা গান লিখতে বললেন। ছেলেটা গান লিখতে বসে গেলো।
এই ছেলেটা কিন্তু ডাক্তারি পড়েছে। কিন্তু ডাক্তারিতে তার মন নেই। একবার তো লেখাপড়া ছেড়েই দিয়েছিল। পরে বাবার মন রাখতে কোনরকমে পাশ করে বের হয়। বাবার হাতে সার্টিফিকেট দিয়ে সোজা জানিয়ে দেয়, সে ডাক্তারি করবে না, লেখালেখি করবে। ছেলের এমন কথা শুনে বাবা খুবই হতাশ হয়েছিলেন।
ছেলেটার তখন মন খারাপ হলেও সে নিজের পথেই চলতে শুরু করলো। রেডিওর জন্য গান লিখে কিছুটা পরিচিতি পেলো সে। তবে তখনও সিনেমার জন্য গান লেখা হয়নি।
ঘুরতে ঘুরতে সে চলে গেল সত্য সাহার কাছে। সত্য সাহা থেকে সুভাষ দত্ত। সেখানে গিয়ে অগ্নিপরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হলো। গান লিখে সুভাষ দত্তকে মুগ্ধ করতে হবে। তাকে মুগ্ধ করা মোটেও সহজ ব্যপার না। কিছুদিন আগে তার পরিচালিত “সুতরাং” ছবিটি মুক্তি পেয়েছে এবং বেশ প্রশংসিত হয়েছে। চারদিকে তখন তার বেশ নামডাক।
১০ মিনিটে ছেলেটা একটা গান লিখে ফেললো। গানটির প্রথম চারটি লাইন এরকম-
“আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল,
বাতাসের আছে কিছু গন্ধ।
রাত্রির গাঁয়ে জ্বলে জোনাকি,
তটিনীর বুকে মৃদু ছন্দ।”
যেই সুভাষ দত্ত ছেলেটাকে প্রায় তাড়িয়েই দিচ্ছিলেন তিনি এই লাইন পড়ে মুগ্ধ হয়ে গেলেন। সত্য সাহার দিকে তাকিয়ে বললেন, “সত্য, এই ছেলে তো অপূর্ব লিখেছে!” এবার সত্য সাহার মুখে গর্বের হাসি। তিনি বললেন, “এই ছেলেটা ইদানিং অপূর্ব সব কাজই করছে!”
মাত্র ১০ মিনিটে লেখা ওই গান দিয়েই সিনেমায় গীতিকার হিসেবে কাজ শুরু করে ছেলেটা। সত্য সাহার সুরে “আয়না ও অবশিষ্ট” ছবিতে গানটি গেয়েছিলেন আঞ্জুমান আরা বেগম। ১৯৬৭ সালে মুক্তি পায় সুভাষ দত্ত পরিচালিত ছবিটি।
সেদিনের সেই ছেলেটা সুভাষ দত্তের মত রাশভারী পরিচালককে যেভাবে তার লেখা দিয়ে মুগ্ধ করেছিল, পরবর্তীতে দশকের পর দশক ধরে সেভাবেই মুগ্ধ করেছে দর্শক শ্রোতাদের। সেদিনের সেই ছেলেটার নাম গাজী মাজহারুল আনোয়ার।
এই একজন গীতিকার এত চমৎকার সব গান লিখেছেন যা কখনো মানুষের মন ছুঁয়ে গেছে, কখনো অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে সংগ্রামে। আপনি তার লেখা বিখ্যাত অনেক গানই শুনেছেন কিন্তু হয়তো জানেন না গানটি গাজী মাজহারুল আনোয়ারের লেখা।
তার লেখা উল্লেখযোগ্য গানের মধ্যে রয়েছে, “জয় বাংলা বাংলার জয়”, “একতারা তুই দেশের কথা বল রে এবার বল”, “একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়”, “পাথরের পৃথিবীতে কাঁচের হৃদয়”, “গানেরই খাতায় স্বরলিপি লিখে”, “যার ছায়া পড়েছে মনেরও আয়নাতে”, “শুধু গান গেয়ে পরিচয়”, “ও পাখি তোর যন্ত্রণা আর তো প্রাণে সয় না”, “ইশারায় শীষ দিয়ে আমাকে ডেকো না”, “চোখের নজর এমনি কইরা একদিন ক্ষইয়া যাবে”, “এই মন তোমাকে দিলাম”, “সে যে কেন এলো না কিছু ভালো লাগে না”, “ও আমার রসিয়া বন্ধুরে তুমি কেন কোমরের বিছা হইলা না”, ইত্যাদি।
রবিবার ( ৪ সেপ্টেম্বর) সকালে জীবনের ওপারে চলে গেছেন বিখ্যাত গীতিকার, চিত্রনাট্যকার এবং চলচ্চিত্র পরিচালক গাজী মাজহারুল আনোয়ার। বাংলাগানের জগতে চিরদিন উজ্জ্বল হয়ে থাকবেন তিনি। জীবনের নানা অনুভূতিতে মিশে থাকবেন তিনি, তার লেখা গান।